সমরেন্দ্র দাস
একসময় বাঙালির একটি বিষয়ে বড় বদনাম ছিল– তারা নাকি বড় আড্ডাবাজ। একবার আড্ডায় বসলে সময়ের আর কোনও জ্ঞান থাকে না। সময় তার নিয়মে গড়িয়ে গেলেও সেই বিষয়ে আড্ডাধারীদের কোনও হিসেবই থাকত না।
গত শতকের পাঁচ কিংবা ছয়ের দশকে দেখেছি প্রায় প্রতিটা পাড়াতেই চায়ের দোকান ঘিরে আড্ডা জমাতেন পাড়া-প্রতিবেশীরা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধু বদলে যেত আড্ডাধারীরা। অর্থাৎ সকাল আটটায় যারা আড্ডা দিতেন সকাল ন’টা কিংবা দশটায় সেইসব সদস্যদের দেখা যেত না। তারা হয়তো অফিস-কাছারিতে তখন চলে গিয়েছেন কিন্তু বেঞ্চে বসার জায়গা কখনোই খালি থাকত না। সেটা দখল করত পাড়ার বেকার ছেলে-ছোকরার দল। সকালে যারা বাজারদর বা রাজনৈতিক টানাপড়েনের কথা বলে গলার শির ফুলিয়েছিলেন সময়ের তারতম্যে তখন প্রসঙ্গ হিসেবে হাজির হয়েছে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা কিংবা উত্তম-সুচিত্রা বা উত্তম-সৌমিত্রকে নিয়ে জোর তর্কাতর্কি। উত্তমকুমারের ইউ কাট চুল নিয়ে বা সদ্য রিলিজ হওয়া উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা নিয়ে মারকাটারি বিশ্লেষণ হত সেই আড্ডায়।
শুধু কি চায়ের দোকানেই এসব আড্ডা জমত? একেবারেই নয়, পাড়ার রোয়াকগুলি ছিল এজন্য একেবারে আদর্শ। রোয়াকের দখল নিত এক এক সময় এক এক দল। অফিস থেকে ফিরে আবার অনেক বাবুই বাড়িতে চা-জলখাবার খেয়ে বিড়ি-সিগারেট পকেটে নিয়ে সামিল হতেন এইসব আড্ডায়। তখন তো টেলিভিশন ছিল না। ছিল রেডিয়োর কোনও় বিশেষ অনুষ্ঠানের হাতছানি। যেমন ফি শুক্রবার রাত আটটা থেকে ন’টা পর্যন্ত নাটকাভিনয় কিংবা শনিবারের দুপুরে অনুরোধের আসরের অনুষ্ঠান। সেই সব ডাক উপেক্ষা না করেই অনেকেই বাড়িমুখো হতেন তাড়াতাড়ি। কিংবা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার আগে তাদেরকে পড়ানোর জন্য তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরতেন কেউ কেউ। এসব আড্ডায় দেখেছি আমাদের পাড়ার আড্ডায় এক সময়ের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী দিলীপ সরকারের সঙ্গে সবিতাব্রত দত্তের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
কোনও কোনও বাড়িতে আবার আড্ডাধারীরা জমায়েত হতেন ভালো চা-চপ খেতে কিংবা অম্বুরী তামাক খাওয়ার টানে। সেখানে প্রতি সন্ধেবেলা তাসের আসরও বসত। রাত ন’টার আগে কেউই নড়তেন না আড্ডা ছেড়ে। যারা খেলতেন না তারাও সেইসব আড্ডাকে অন্য মাত্রা যোগ করতেন টীকা-টিপ্পনির মাধ্যমে।
এসব আড্ডায় নববিবাহিত পুরুষরা মাঝে মাঝেই বড় বিপদে পড়তেন। যখনই স্ত্রীকে নিয়ে ইভিনিং শো-এ সিনেমা বা থিয়েটার দেখতে গেলে তার পরের দিন তার পেছনে মহা সমারোহে লেগে যেতেন বাকিরা। মিটমাট হত কোনও কিছু ভোজের পরিবর্তে।
আমাদের পাড়ায় থাকতেন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। তাঁর মুখ থেকে শুনেছি নতুন কবিতা লিখে সটান হাজির হয়েছেন প্রিয় বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্রের ডেরায়। তখনও তাঁরা দু’জনে কেউ চাকরিতে যোগদান করেননি। নতুন কবিতা শুনিয়ে বাড়ি ফিরবেন বলে পা বাড়ালে প্রেমেন্দ্র তাঁকে এগিয়ে দিতে গিয়ে মুখে মুখে অচিন্ত্যকে শুনিয়ে দিয়েছেন চটজলদি নতুন কবিতা। একে অপরকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে কতদিন রাস্তাতেই আড্ডা জমিয়েছেন এই দুই কিংবদন্তি সাহিত্যিক। আর সেই পথের আড্ডাও চলত নাকি দু’-তিন ঘণ্টা ধরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাজে কথা’ বা ‘পনেরো আনা’ যাঁরা পড়েছেন তাঁরা অতন্ত মানবেন যে জীবনের প্রতি মুহূর্ত যদি কাজের হয়ে উঠত তাহলে পৃথিবীময় শুধুই শস্য ফলত, ফুল আর ফুটত না কোথাও!
ছবি ঋণ : ইন্টারনেট